চেহারার মিল, মিথ্যা অভিযোগ: রাজনীতির নগ্ন রূপ
রাজনীতি—একসময় যাকে বলা হতো জনকল্যাণের মহৎ কর্মযজ্ঞ—আজ তা অনেক জায়গায় সত্যতা, যাচাই, বাছাই, বুদ্ধি ও বিবেচনার অভাবে এক ভয়ংকর স্বার্থপর কর্মকাণ্ডে রূপ নিয়েছে। ন্যায়ের আদলে জন্ম নেওয়া এই কাঠামো ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অস্ত্র, যেখানে প্রকৃত সত্য নয়, বরং ব্যক্তির প্রয়োজন অনুযায়ী সত্য নির্মাণ হয়।
বর্তমান সময়ে প্রশ্ন উঠছে, রাজনীতির নামে যা চলছে—তা কি আদৌ জনকল্যাণের চেষ্টা, নাকি এক গভীর ব্যক্তিগত ষড়যন্ত্রের নাট্যমঞ্চ?
চেহারার মিল দিয়ে অপবাদ ও রাজনৈতিক চরিত্রহননের নোংরা কৌশল
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, কোনো রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একটি নতুন প্রবণতা তৈরি হয়েছে—একজন ব্যক্তির চেহারার সাথে কোনো দুষ্কর্মের ভিডিও বা ঘটনার মিল পেলেই, যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেই ব্যক্তির এবং তার দলের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মিথ্যাচারের একটি নির্লজ্জ উদাহরণ তৈরি হয়েছে "সমন্বয়ক রুবাইয়া ইয়াসমিন" কে ঘিরে। বেশি কিছু আওয়ামীপন্থী ও কিছু বিএনপি পন্থী পেজ উদ্দেশ্যমূলকভাবে রুবাইয়া ইয়াসমিনের নামে গুজব ছড়াতে শুরু করে। অথচ, ছবির ও ভিডিওর প্রকৃত সত্য হলো—ওগুলো ‘Mx Juthi’ নামের এক টিকটকারের কনটেন্ট ছিল, যার সাথে রুবাইয়া ইয়াসমিনের কোনো সম্পর্কই ছিল না।
চেহারার কিছুটা মিল এবং দৃষ্টির বিভ্রান্তি কাজে লাগিয়ে রুবাইয়া ইয়াসমিনকে সামাজিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করা হয়।
যাচাই-বাছাই ছাড়াই এসব ছবি ও ভিডিও ভাইরাল করা হয়, যার ফলে একজন নিরপরাধ মানুষকে নৈতিক এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চলে।এ ধরনের চরিত্রহনন শুধু যে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ, তা-ই নয়, বরং তা আমাদের সমাজের নৈতিক পতনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
তার আগেও মানসুরা আপাকে নিয়ে চালানো কুরুচিপূর্ণ প্রচারণা কোনোভাবে প্রমাণিত হয়নি; বরং এটি উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার হিসেবেই গণ্য হয়েছে।
একই প্রবণতা দেখা যায় ২০২৪ সালে চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়। প্রথমে ভিডিওটি মুর্শিদাবাদের বলা হলেও, পরে BOOM Fact-Check নিশ্চিত করে এটি বাংলাদেশেরই এক যুবলীগ নেতার দৃশ্য।
একইভাবে, ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সাংসদ তামান্না নুসরাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে—তিনি নিজের জায়গায় পরীক্ষায় অংশ নিতে সাদৃশ্যপূর্ণ আটজন নারী ভাড়া করেছিলেন। দৃষ্টির বিভ্রান্তি ও মুখের মিলকেই ব্যবহার করে এককথায় গোটা বিষয়টি রাজনৈতিক উত্তেজনায় পরিণত করা হয়। (সূত্র: The Guardian, ২০১৯)
মিথ্যা প্রচারের হাতিয়ার হিসাবে অশালীন ভিডিও
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কালিমালিপ্ত করতে "অশালীন ভিডিও" একটি বহুল ব্যবহৃত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সাদৃশ্য বা অল্প মিলকে পুঁজি করে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকেও সমাজের কাছে নিন্দিত করা হয়। বিচারের কোনো সুযোগ থাকে না। ক্ষয় হয় ব্যক্তির সম্মান, ভেঙে পড়ে তার সামাজিক অবস্থান।
নোমান চমস্কি যা বলছিলেন ‘মিথ্যা বাস্তবতার নির্মাণ’
বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ নোমান চমস্কি তাঁর বই “Manufacturing Consent” এ ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে গণমাধ্যম ও রাজনীতি হাত ধরাধরি করে মিথ্যা প্রচারণা নির্মাণ করে। তাঁর মতে:
“মানুষকে সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রথম কাজ হলো সত্যকে বিকৃত করা। একসময় মানুষ বুঝতেই পারে না, তারা কোনটা মিথ্যা এবং কোনটা সত্য।”
আজকের রাজনৈতিক অঙ্গন যেন চমস্কির এই তত্ত্বের জীবন্ত প্রমাণ।
রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি ও পারিবারিক দখলদারি
বর্তমান বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনে আজ চাঁদাবাজি, অযোগ্য নেতৃত্ব, দমবন্ধ পরিবেশ, এবং পরিবারতন্ত্রের একচেটিয়া দখল চলে এসেছে।
যুক্তি, তথ্য, গণতান্ত্রিক মতবিনিময়—এসবের জায়গায় জায়গা করে নিয়েছে অন্ধ আনুগত্য, পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত এবং নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর কৌশল।
রাজনীতির নামে এখন অনেক জায়গায় দেখা যায়:
- চাঁদাবাজি ও লুটপাট উন্মুক্তভাবে চলতে থাকে।
- যুক্তি ও সত্যের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকে না।
- রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত পরিবারতন্ত্রে পরিণত হয়।
- দমবন্ধ পরিবেশে নতুন চিন্তাধারা দমিত হয়।
- ন্যায়সঙ্গত সমালোচনাকে শত্রুতা মনে করা হয়।
উদাহরণ স্ররুপ পরিবারতন্ত্র বনাম গণতন্ত্রের লড়াই
পাকিস্তানের ভূট্টো পরিবার, ভারতের গান্ধী পরিবার কিংবা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারগুলোর ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়—কিভাবে গণতন্ত্রের শিকড়ে পরিবারতন্ত্রের বিষবৃক্ষ গেঁড়ে বসে। যেখানে মতের ভিন্নতা মানেই দলত্যাগ, আর সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রদ্রোহী তকমা।
এই রাজনীতি পবিত্র হবে কবে?
রাজনীতি যদি সত্যতা, যাচাই, বাছাই, বুদ্ধি ও বিবেচনার মুলনীতিতে না ফেরে—তবে তা মানুষের জন্য নয়, বরং গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার জন্য একটি নির্মম যন্ত্র হয়ে দাঁড়াবে।
আজকের প্রেক্ষাপটে যদি ন্যায়, যুক্তি ও দায়িত্ববোধের সংস্কৃতি ফিরিয়ে না আনা যায়—তবে সময়ের স্রোতে রাজনীতি নামক শব্দটি একদিন চোরাগোপ্তা স্বার্থের প্রতিশব্দ হয়ে উঠবে।
কেউ তখন আর বলবে না—“রাজনীতি মানুষের জন্য।” বরং মানুষ বলবে—“রাজনীতি মানেই মিথ্যা, প্রতারণা আর ধোঁকা।”
Comments
Post a Comment